অগ্রদৃষ্টি ডেস্ক: ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডে ডাইনি সন্দেহে রবিবার রাতে একই পরিবারের তিনজনকে পুড়িয়ে মারার পর আজ মঙ্গলবার ওই ঘটনায় অন্তত দশজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রাজ্যের পুলিশ বিবিসিকে জানিয়েছে, স্থানীয় গ্রামবাসীরা ওই পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল তারা বলি দেয়ার জন্য ছোট ছেলেমেয়েদের অপহরণ করেছে– কিন্তু সেই অভিযোগের আদৌ কোনও সত্যতা মেলেনি।
ডাইনি অভিযোগে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মারার ঘটনা আদিবাসী-অধ্যুষিত ঝাড়খন্ডে মোটেও বিরল নয়, এবং পুলিশ বা প্রশাসনের বিস্তর চেষ্টা সত্ত্বেও এই প্রথা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
ঝাড়খন্ডের লোহারডাগা জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কাইরোতে রবিবার রাত দশটা নাগাদ শত শত গ্রামবাসী লাঠিসোঁটা ও মশাল নিয়ে ঘিরে ধরেছিল গোবর্ধন ভগতের বাড়ি।
গ্রামের মোটামুটি সম্পন্ন পরিবার তারা, ছেলেরা বিএসএফ বা পুলিশে কাজ করে। বাড়ির কর্তা গোবর্ধন ভগত নিজে অবশ্য বছর পনেরো আগে একটি বাচ্চা ছেলের মাথা কাটার অভিযোগে জেল খেটেছিলেন।
সে রাতের ঘটনার বিবরণ দিয়ে জেলার পুলিশ-প্রধান কার্তিক এস বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ওই গ্রামবাসীরা তার বাড়িকে ঘিরে ফেলে শ্লোগান দিতে থাকে – বাচ্চাদের বলি দেওয়া চলবে না, আমরা ওদের উদ্ধার করতে এসেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে অবশ্য ওরকম কোনও বাচ্চা ও বাড়িতে ছিল না, পুরোটাই ছিল মিথ্যা গুজব।”
“কিন্তু উত্তেজিত গ্রামবাসীরা এক পর্যায়ে বাড়ির লোকদের ভেতরে আটকে রেখেই সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয় – বাড়িতে তখন মোট সাতজন সদস্য ছিলেন, তাদের চারজনকে আমরা কোনক্রমে উদ্ধার করতে পারলেও তিনজনকে বাঁচাতে পারিনি”, জানান পুলিশ-প্রধান।
এর পরই পুলিশ গ্রামের পঁচিশজন ব্যক্তি ও আরও পাঁচশো বেনামি লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে এবং তাদের মধ্যে থেকে মঙ্গলবার দশজনকে গ্রেফতার করা হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ভিক্টিমরা কথা বলার মতো অবস্থায় এলে তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আরও অনেক অভিযুক্তকে চিহ্নিত করা যাবে বলে পুলিশ ধারণা করছে।
তারা আরও মনে করছে, এই পুরো ঘটনার পেছনে ছিল গ্রামের এমন একটা ধারণা যে গোবর্ধন ভগত ডাইনিবিদ্যার চর্চা করেই পরিবারে আর্থিক উন্নতি নিয়ে এসেছেন।
এই ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে সম্প্রতি বারবার মুখ খুলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেও।
মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস জনসভায় বলেছেন, “এ রাজ্যে বারবার নির্দোষ মহিলারা এই কারণে প্রাণ দিচ্ছেন। রাঁচিতে কিছুদিন আগে পাঁচজন মহিলাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, পশ্চিম সিংভূম থেকেও এমন ঘটনার কথা প্রায়ই কানে আসে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, ওঝাদের ফাঁদে পা-দিয়ে এভাবে নির্দোষ লোকেদের প্রাণ নেয়াটা আদিবাসী সমাজের কলঙ্ক – যা আমাদের ঘোঁচাতেই হবে।”
ঝাড়খন্ডে ডাইন বা ডাইনি সন্দেহে কাউকে মেরে ফেলার ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটে, কেন ঘটে তা নিয়ে গবেষণা করেছেন ডিসকভারি মিডিয়া নেটওয়ার্কের শ্যারন উইলিয়ামস।
তিনি বলেন, “ওঝারা অনেক সময় সন্দেহভাজনদের নাম লিখে এক একটা চালের পুঁটলি পিঁপড়েদের খেতে দেন। যে পুঁটলিটা আগে শেষ হয়, তাকে ডাইনি বলে শনাক্ত করা হয়। গাছের ডালে নাম লিখেও অনেক সময় দেখা হয়, কোন ডালটা আগে মরে।’
“এর পেছনে কুসংস্কার, অশিক্ষা তো আছেই – তা ছাড়া একটা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও কিন্তু আছে বলেই মনে হয়। বিধবা মহিলাদেরই বেশি ডাইনি বলে মারা হয়ে থাকে – যাতে তাদের জমি বা সম্পত্তি সহজে জব্দ করা যায়।”
লোহারডাগার ঘটনাতেও কোনও অর্থনৈতিক কারণ ছিল কি না, গোবর্ধন ভগত ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কারা কেন গুজব ছড়িয়েছে – তার সবই এখন পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।